লিখছেন তন্ময় মুখার্জী (Bongpen)
মাঝে মাঝে মনে হয়, পিতার মেজাজ-খানি নারী হৃদয়ের মতই গভীর ও বিপদসংকুল এক ধাঁধা বিশেষ। পিতা’র রাগ কখন সপ্তমে চড়ে আমায় কোপ্তা বানাবে আর কখন রাশ টেনে আমায় ঢিমে আঁচে আলতো সেঁকবে, তা ঠাহর করা ভারী মুশকিল।
সেই অঙ্ক পরীক্ষার উর্বর ক্ষেতে যবে থেকে বাতাবি লেবুর ফসল ফলিয়ে চলেছি, তবে থেকে দেখে আসছি, তার মেজাজকে ট্র্যাক করা আর শর্ট হ্যান্ডে হাইরোগ্লিফিক্স’য়ের পাঠোদ্ধার করা প্রায় একই ব্যাপার। তবে এটুকু আঁচ অবশ্যি পেয়েছি যে পিতার রাগ বিভিন্ন স্তরে রয়েছে, এক এক স্তরে রাগের বিন্যাস এক এক রকম। এবং আমার বিশ্বাস পিতামাত্রই তারা নিজেদের মগজে, চরিত্রে ও মেজাজে এই স্তরগুলোকে লালন করে চলেছেন।
পিতৃত্বের মেজাজের গুনগুলোর তরল মিশ্রণটিকে একটি স্বচ্ছ কাচের বোতলে পুরে, ভালো করে ঝাঁকিয়ে, যদি আধ ঘণ্টা রেখে দেওয়া হয় থিতিয়ে যাওয়ার জন্যে, তবে দেখা যাবে যে তিনটি নিখুঁত স্তর কাচের বোতলটির মধ্যে স্পষ্ট হয়ে আছে।
সত্যি। সত্যিই তাই।
সবার নিচের যে স্তর; ঘন, ঘোলাটে, কালচে এবং সম্পূর্ণ ভাবে অস্বচ্ছ; সে স্তরটিকে ছবি বিশ্বাস-স্তর হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।
পিতৃত্ব এখানে ঘ্যামের ভারে ন্যুব্জ। পিতা এখানে বড়কর্তা, সন্তান বাজার-সরকার।পিতা যখন এই স্তর থেকে সন্তান-সঞ্চালনা করেন, তখন তার মুখের প্রতিটি কথা বেরিয়ে আসে মেগা-চিবুনির পরে; স্বল্প, ধারালো, অভ্রান্ত। এ স্তরে পিতার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ও বক্তব্য মূলত বিরক্তি ও মাছি তাড়ানো ভিত্তিক। সন্তান, তখন তুই-তুমি সম্বোধনের ওপারে, সন্তানকে ডাইরেক্ট ডাক দিয়ে পিতা নিজের ওজন কমাতে নারাজ। যথা – “ভর দুপুরে ছাদে কি করা হচ্ছিল?” অথবা “বাতেলায় ডক্টরেট করতে পারলে কেরিয়ারের সুরাহা হবে কি?”। শ্লেষ ও টিপ্পনীর ওপর নির্ভর করেই পিতারা এ স্তরে অপারেট করে থাকেন। কোনও শুনানি নয়, আলাপআলোচনা নয়, স্রেফ দৃষ্টির সামনে থেকে মুছে ফেলা সে বিরক্তির ভাব; ছবি-বিশ্বাস’ইও পিতা।
দ্বিতীয় স্তরটি লালচে, প্রায় অস্বচ্ছ। এ স্তর রক্তারক্তির। ডাইরেক্ট। চোস্ত-যুক্তি বিন্যাসে খুনে। হৃদয় উপড়ে ফেলা দৃষ্টি আর উড়িয়ে দেওয়া সন্তানের চরিত্র-নির্ধারণ-মূলক সমস্ত সিদ্ধান্ত’য়ের ঝড়।
“ তুমি আই আই টি ছেড়ে সিনেমার ওয়ার্কশপে জয়েন করবে? এ সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে গেলে তোমার জানা উচিৎ কত ধানে কত চাল। তোমার মত আহাম্মককে আমার নিজের ছেলে হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে”
অথবা
“ তুমি আই পি এল’য়ের টিকিট কেটেছ? ইডেনে যাবে সার্কাস দেখতে? সোবার্স, জাহির আব্বাস, গাওস্করের গল্পে তোমায় বড় করলাম, আর তুমি চললে ক্রিকেটের নামে বেলেল্লাপনা দেখতে? তোমার মত আহাম্মককে আমার নিজের ছেলে হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে”
এক্কেবারে ঘ্যাচাং ফুঁ স্তর; কমল মিত্র স্তর।
তৃতীয় স্তরটিতে স্বচ্ছ সবুজ আভা, পিতা অনেক বেশি ডেমোক্র্যাটিক। রাগ আছে। কিন্তু হৃদয়ের খেলও আছে। ইমোশনাল আদান-প্রদান রয়েছে, বক্তব্যের লেন দেন রয়েছে।
পিতা এখানে আদুরে বকুনিতে খেলা করেন, অনেক বেশি মাই ডিয়ার। তুমি’র আড়াল নয়, পিতা অপারেট করেন খোলামেলা তুই’তে। তার রাগ অনেক বেশি সমঝদার। কাঁধে হাত রেখে পিতা তাঁর বক্তব্য সাজান। বোঝান। তাঁর রাগ এখানে কড়াই ভর্তি টগবগে তেল নয়, বরং উষ্ণ স্যুপের মত উপাদেয়।
“আহা, একটা ভুল না হয় করে ফেলেছিস, কিন্তু চেষ্টা করে দেখি শুধরে নেওয়ার”
“আমি তো কিছুতেই বুঝতে পারছি না তোর মত এমন ইন্টেলিজেন্ট ছেলে এমন একটা এরর্ অফ জাজমেন্ট কি করে কমিট করলি। আরে শোন শোন…”
পরিশীলিত মেজাজের স্তর এটি; পাহাড়ি সান্যাল স্পেশাল।
ছবি-কমল-পাহাড়ি মেজাজ মিলে পিতার মেজাজ খানি ছায়া মেলে রয়েছে। যতদিন সে স্নেহ আঁকড়ে পরে থাকা যায় – এই আর কি।
Categories: Recommended
Oh My God…porte porte ami enader golar shwar sunte pachchilam. oshadharon analysis 🙂
LikeLike
অসাধারণ। এর পরের সংস্করণে পরবর্তী যুগের বাবাদিগকেদের ভেন ডায়াগ্রাম দেখতে চাই।
যথা, জনৈক উত্তর কলকাতার মল্লিক বাবু “তোমায় মুখে যদি একবারে তিন খানা রসগোল্লা পুরে দেওয়া যায় তাহলে সময় নষ্ট করে একটা একটা করে খাচ্ছ কেন?’ এনারা বিশেষ করে মেয়েদের বাবা হয়ে থাকেন।
ছেলেদের বাবা হবার জন্য আইডিয়াল হলেন ভিক্টর ব্যানার্জির মতন মাথা ঠান্ডা ব্যক্তিবিশেষ। যথা, ” রসগোল্লার টিন থেকে জিনিস গুলো ঢেলে গামলা করে সার্ভ করতে কি বিয়ের পরে বউ এসে সেখাবে ।”
আর এদের ইন্টার সেকশন পয়েন্ট এ হল আদি চন্দননগরের এর বিখ্যাত ব্যেক্তিত্ব। “তুমি কোথাকার মাল হে যে রস চিপে রসগোল্লা খাচ্ছ?”
দারুন ব্লগ।
LikeLike
Aapni guru. Oshadgaron lekha. Specially Chhobi Biswas stor ta
LikeLike